ইলম কাকে বলে?
ইলম এর শাব্দিক অর্থ জ্ঞান। ইলম আরবী শব্দ, বাংলা ভাষায় যেটি এলেম নামে পরিচিত। ইসলামী পরিভাষা অনুসারে কুরআন হাদীস তথা ইসলামের জ্ঞান কে “ইলম” নাম বলা হয়। ইলম তথা জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে আমল অতীব গুরুত্বপূর্ণ কেননা আমলবিহীন “জ্ঞান” ইলম হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য নয়। ইলম ও আমল ওতপ্রোতভাবে পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। ইলম যদি হয় একটি বীজ তবে, আমল হলো সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত বৃক্ষ।
ইলম অর্জনের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয় ও ফজিলত
“কুরআনে ‘আলিম’ শব্দটি ১৪০ বার এবং ‘আল-ইলম’ শব্দটি ২৭ বার এসেছে। সব মিলিয়ে ‘ইলম এবং এ’সম্পর্কিত শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে এমন আয়াতের সংখ্যা মোট ৭০৪টি। এছাড়াও ক্বালাম শব্দটি ২ বার এবং ২৩০টি আয়াতে ‘আল-কিতাব’ শব্দটি এসেছে, যার মধ্যে ৮১টি আয়াতে এর দ্বারা ‘আল-কুরআন’ কে বোঝানো হয়েছে। এছাড়াও ইলম সম্পর্কিত অন্যান্য শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে আরও ৩১৯টি আয়াতে।”
- কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে (কুরআন-হাদীছের) জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তা’আল তাদের মর্যাদা অনেক উঁচু করে দেন (সূরা মুজদালাঃ ১১)
- আল্লাহ যার কল্যান চান তাকে দ্বীনি বুঝ দান করেন। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম) অর্থাৎ আল্লাহ তা যেসমস্ত বান্দার ভাল চান তাদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের রাস্তা বাতলে দেন।
- হযরত আবূ গিফারী (রাঃ) বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ হে আবূ যর! তুমি যদি সকাল বেলায় গিয়ে একটি অধ্যায় শিক্ষা কর, তাহলে তোমার জন্য তা এক হাজার রাকায়াত নফল পড়া থেকেও উত্তম। (ইবনে মাজাহ)
- শিক্ষা ইসলামের প্রাথমিক মৌলিক বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত। আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩২)।
- শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের জন্য পঠন-পাঠন অন্যতম মাধ্যম। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন “আলাক” থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ১-৫)।
- ইসলামি শিক্ষায় অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার মূল পাঠ্যগ্রন্থ আল–কোরআন। ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)।
অতএব, স্পষ্টতই ইলমের ইলমের গুরুত্ব ও ফজিলত অনস্বিকার্য।
কতটুকু ইলম অর্জন করা ফরজ
আবশ্যিক পরিমান ইলম হাসিল করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরযে আইন। ফরযে আইন হলো আবশ্যিক পরিমান কাজ যা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর আদায় করা বাধ্যতামূলক। আর ফরজ তরক করা তথা ভঙ্গ করা হলো কবীরা গোনাহ।
ইসলামের আবশ্যক বা ফরজ হুকুম-আহকাম মেনে চলার জন্য জন্য যতটুকু ‘ইলম’ বা ‘জ্ঞানার্জন” প্রয়োজন তাকে ‘ফরজে আইন’ বলে। এতটুকু জ্ঞানার্জন আবশ্যক। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরজ কেননা এটি ছাড়া ফরজে আইন সমূহ পালন করা সম্ভব নয়।
আবার, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জ্ঞানার্জন করা যা অন্যেরও উপকারার্থেও প্রয়োজন, তা হাছিল করা “ফরজে কেফায়া”। একটি সমাজে প্রয়োজন অপেক্ষা অতিরিক্ত জ্ঞানসম্পন্ন কতক লোক আবশ্যই থাকতে হবে, যারা দ্বীনের জটিল ও বিতার্কিক বিষয় সমূহে কুরআন এবং সুন্নাহ অনুসারে সঠিক ও যৌক্তিক ব্যাখাা দিতে পারে। সমাজে এমন লোকের অভাব থাকলে সেই সমাজের সকলেই ফরজ তরকের বা ভঙ্গের পাপে পাপী হবে। তাই যা বলছিলাম, এলাকায় অবশ্যই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজ্ঞ আলেম থাকতে হবে।
ইলম তথা জ্ঞানের প্রকারভেদ, কত প্রকার ও কি কি
‘ইলম’ দুই প্রকার। প্রকারভেদ নিচে দেখুন।
- দ্বীনী ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান)
অর্থাৎ, যে সমস্ত জ্ঞান শুধুমাত্র ইসলামী ফরজে আইন মেনে চলতে প্রয়োজন হয়।
- দুনিয়াবি ইলম (পার্থিব জ্ঞান)
অর্থাৎ, যে সমস্ত জ্ঞান বা বিদ্যা দুনিয়াবী বা এই নশ্বর পৃথিবীতে জীবন ধারনে কিছু ক্ষেত্রে বিলাসিতার জন্য প্রয়োজন হয়।
ইলম অর্জনের পদ্ধতি
সাধারণত তিন পদ্ধতিতে ইলম হাসিল করা যায়।
- নিয়মিত কোনো উস্তাদ থেকে।
- দ্বীনী কিতাবাদি পাঠ করে।
- কারো থেকে ওয়াজ নসিহত, আলোচনা শুনে বা প্রশ্ন করে।
এখন চলুন এই তিনটি পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদভাবে জেনে নেওয়া যাক।
১. উস্তাদ নির্বাচন ও ইলম অর্জন
- উস্তাদ হাক্কানী ব্যক্তি হতে হবে অর্থাৎ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জা’মাতের অনুসারী হতে হবে কোনো বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে উস্তাদ বানানো যাবেনা।
- উস্তাদের চিন্তাধারা ঠিক থাকতে হবে নতুবা ছাত্রের চিন্তা ধারাও সঠিক হয়ে গড়ে উঠবে না।
- উস্তাদের মধ্যে ইলম অনুযায়ী আমল থাকতে হবে।
- আদর্শবান ব্যক্তি হতে হবে এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত মানের হতে হবে।
২. গ্রন্থ পাঠের নীতিমালা
- কিতাব নির্বাচনের সময় লেখক নির্ভরযোগ্য কিনা, তিনি ভাল জাননেওয়ালা ব্যাক্তি কিনা। যার লেখা কিতাব পাঠ করে ইলম হাছিল করা হবে তিনিও তিনিও উস্তাদের পর্যায়ভুক্ত; অতএব উস্তাদ নির্বাচনের শর্তগুলো গ্রন্থ নির্বাচনেও প্রযোজ্য হবে।
- বিজ্ঞ আলেম নন- এমন ব্যক্তির জন্য কোন বাতিলপন্থি ও বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লিখিত বই-পত্র পাঠ করা ঠিক নয়।
- কোন ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে কোন বিষয় সন্দেহপূর্ন, অস্পষ্ট বা ত্রুটিযুক্ত মনে হলে দ্বীনী ইলম সম্পর্কে বিজ্ঞ আলেম ব্যক্তি থেকে সেটা বুঝে নিতে হবে।
- গ্রন্থের মধ্যে কোথাও কোন মাসআলা বা বর্ননা যদি নিজেদের মাযহাবের খেলাফ মনে হয়, তাহলে সে অনুযায়ী আমল করা যাবেনা। জানার জন্য সেটা পড়া যাবে, কিন্তু আমল করতে হবে, নিজেদের ইমামদের মাযহাব ও মাসায়েল অনুসারে। প্রয়োজন বোধ হলে নিজেদের মাযহাব সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেওয়া যাবে।
- দ্বীনী কিতাব এর আদব রক্ষা করতে হবে। দ্বীনী কিতাবাদির উপর বসা বা শয়ন করা যাবেনা।
৩. ওয়াজ নছিহত বা দ্বীনী আলোচনা শোনার নীতিমালা
- সর্বপ্রথম দেখতে হবে তার আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সহীহ কি-না এবং তিনি হকপন্থী কিনা। নিজের জানা না থাকলে কোন আলেম থেকে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
- জেনে নেয়ার পরও তার বক্তব্য সন্দেহপূর্ন মনে হলে কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে সে সম্পর্কে তাহ্কীক তথা হাদিসটির বিশ্লেষন করে নিতে হবে। তাহ্কীফ করার পুর্বে সে অনুযায়ী আমল করা বা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা যাবেনা।
ইলম হসিল করার শর্ত ও করনীয়
- নিয়ত সহীহ করে নিতে হবে। অর্থাৎ আমল করা ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে ইলম্ হাসিল করতে হবে। জ্ঞান অর্জন করে মানুষের সঙ্গে তর্কে বিজয়ী হাওয়া বা অহংকার প্রদর্শন কিংবা সম্মান অর্জন প্রভৃতি নিয়ত রাখা যাবে না।
- কিছু জানিনা এরূপ মনোভাব নিয়ে ইলম্ সন্ধানে থাকতে হবে। জানার জন্য আগ্রহ এবং মনের ব্যাকুলতা থাকতে হবে। ‘আমি অনেক জানি’ এরূপ মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে সেই মনে নতুন ইলম্ ঢুকবে না। তবে এর অর্থ নয় যে বিনা বিচারে সকলের কথা গ্রহণ করতে হবে। বরং, কোন বিষয়ে সন্দেহপূর্ণ মনে হলে অবশ্যই তা তাহকীফ্ (হাদিসের বিশ্লেষন) করে নিতে হবে।
- দ্বীনী ইলমের আজমত সম্মানবোধ অন্তরে রাখতে হবে । এই ইলম শিক্ষা করে কি হবে এরূপ হীনমন্যতা পরিহার করতে হবে।
- গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কেননা পাপীদের অন্তরে সঠিক ইলম্ প্রবেশ করেনা।
- উস্তাদ ও কিতাবের আদব রক্ষা করতে হবে। উস্তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হবে এবং উস্তাদের হক আদায় করতে হবে।
- উস্তাদের জন্য দুআ করতে হবে। কিতাব পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করা হলে সেই কিতাবের লেখক এর জন্য দোয়া করা কর্তব্য।
- ইলম্ অর্জনের জন্য মেহনত করতে হবে
- যতক্ষণ কোন বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা সম্ভব না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত উস্তাদকে বারবার জিজ্ঞেস করে ধারণা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- ইলম বৃদ্ধির জন্য এবং ভালোভাবে বুঝে আসার জন্য আল্লাহ কাছে দোয়া করতে হবে।
- ইলম অর্জন করে অন্যকে শিক্ষা দেয়া এবং এই ইলম অনুযায়ী আমল করার জন্য অন্যকে দাওয়াত দেয়ার নিয়ত রাখতে হবে।
আপনার উদ্দেশ্যে
প্রশ্ন আসতে পারে, জাগতিক ইলম্ নিয়ে। আসাটাই স্বাভাবিক, কারন ছোটবেল থেকে একজন মুসলিমের ঘরে বড় হয়েও আমরা জানিনা, এই পৃথিবীতে আমাদের কোন জ্ঞানার্জন আগে করতে হবে আর কোনটা পরে। জানিনা, সেটাও আবার যথার্থ ইলম্ এর অভাবে।
তাই শেষে আমার প্রতি আপনার একটা অনুরোধ থাকবে, আপনি কোন ইলম্ কে আগে রাখবেন? আপনার জন্মের পূর্বের সময়কাল কত ছিল, আপনার মৃত্যুর পরে কত? অসীম! অসীম থেকে জীবনের গড় আয়ু (৭০ বছর) বিয়োগ করেন।
কত থাকবে?
অসীমই।
জাযাকাল্লাহু খায়রান।
তথ্যসূত্রঃ আহকামে যিন্দেগী, মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েদ উদ্দীন
আপনার পোষ্টটি পড়ে নানা বিষয় জানতে পারলাম। এবং ইলম ও ইলমের বিষয় অনেক কিছু জানতে পারলাম। এবং অনেক উপকৃত হলাম। পোষ্টটি করার জন্য ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহ! আমার ভেবে খুশি লাগছে আমি আপনাকে কোনোভাবে উপকার করতে পারলাম।