মাটির ময়না (The Clay Bird) চলচ্চিত্রটি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে। ২০০২ সালে এ সিনেমাটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে প্রচার করা হয়। তবে এই সিনেমাটি শুধু বাংলাদেশে নয়, ২০০২ সালে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।
আর সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই চলচ্চিত্রটি মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ চলচ্চিত্রটিতে পরিচালক তারেক মাসুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। চলচ্চিত্রটিতে তারেক মাসুদ পরিচালকের ষাটের দশকের ছেলেবেলা স্মৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রেক্ষাপট
মাটির ময়না (Matir moina) (২০০২) সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রেক্ষাপটে একটি বাংলাদেশী ফিচার চলচ্চিত্র। এটি তখন আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনা করেছেন তারেক মাসুদ। প্রযোজনা করেছেন ক্যাথরিন মাসুদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ষাটের দশকে পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থা এবং সেই সময়ে তারেক মাসুদের ছেলেবেলার মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এই চলচ্চিত্রে। সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রে ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করা হলেও মূল কাহিনিতে একটি কিশোরের মানবিক অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হয়েছে। মাদ্রাসায় তার শিক্ষক, সহপাঠী এবং পরিবারের সাথে তার সকল আচরণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে।
মাটির ময়না ছবির কাহিনী
ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান যে উত্তাল সময় পার করছিল ঠিক সেইসময় একটি পরিবার কিভাবে যুদ্ধ এবং ধর্মের কারনে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল সে গল্পকে তুলে ধরা হয়েছে।
এই চলচ্চিত্রটিতে পরিচালক নিজের জীবনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। এখানে পরিচালকের বাবা কাজী সাহেব ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ এবং তার ছোট ছেলের পড়াশোনার জন্য মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। ইতিমধ্যে দেশের রাজনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি অনিয়ম ও মধ্যপন্থী ঘটে। আর এ নিয়ে কাজী সাহেব এবং তার স্বাধীনচেতা স্ত্রী আয়েশার সাথে বিভিন্ন ধরনের মতবিরোধ হয়।
মাটির ময়না সিনেমাটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বিচিত্র এবং ইসলামের দুর্বোধ্যতার প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তব জীবন কাহিনী এবং ষাটের দশকের মানুষের চরম মানসিক অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে এই চলচ্চিত্রে।
অভিনেতা-অভিনত্রী ছিলেন যারা
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের সকল গুণী শিল্পীরা কাজ করেছে এবং তাদের চরিত্র এমনভাবে পরিচালক ফুটিয়ে তুলেছেন যেন বাস্তব প্রতিচ্ছবি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে সিনেমাটোগ্রাফিতে (চলচিত্রগ্রহনশিল্প) বাংলাদেশের ছয় ঋতুর বৈচিত্র এবং সে সময়কার অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
শিল্পীদের বাস্তব নাম | শিল্পীদের চরিত্রের নাম | চলচ্চিত্রে শিল্পীদের মধ্য সম্পর্ক |
নুরুল ইসলাম বাবুল | আনু | প্রধান চরিত্র |
রাসেল ফরাজী | মোঃ রোকন উদ্দিন | বন্ধু |
রকেয়া প্রাচি | আয়েশা | আনুর মা |
শোয়েব ইসলাম | মিলন | আনুর চাচা |
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় | কাজী | আনুর বাবা |
লামিসা রিমঝিম | আসমা | আনুর ছোট বোন |
মইন আহমেদ | ইব্রাহিম | মাদ্রাসার শিক্ষক |
মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন | মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক | |
শাহ আলম দেওয়ান | করিম | মাঝি |
আব্দুল করিম | হালিম মিয়া | – |
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের নির্মাতা কে?
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের নির্মাতা বা পরিচালক কে? বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত মাটির ময়না চলচ্চিত্রের রচনা ও পরিচালনা করেছেন তারেক মাসুদ। এটি পরিচালক তারেক মাসুদের সর্বপ্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। অন্যদিকে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন তারেক এবং ক্যাথরিন মাসুদ।
আর এই চলচ্চিত্রটি ২০০২ সালে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনীর উপর নির্মাণ করেছেন। তবে চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পায়।
মাটির ময়না রিভিউ
মাটির ময়না (২০০২) সিনেমা রিভিউ
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি যুগ যুগ ধরে দর্শক প্রিয় হয়ে আছে। একটি মানসম্মত চলচ্চিত্র ও অর্জনের দিক থেকে চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তারেক মাসুদের পরিচালিত মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নজরুল ইসলাম। যাকে মাটির ময়না সিনেমাতে আনু চরিত্রে দেখতে পাবেন। এছাড়াও রয়েছে রাসেল ফরাজী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রকেয়া প্রাচি, ইসলাম এবং লামিসা সাথে রিমঝিম। মাটির ময়না চলচ্চিত্রের মোট ৩৫ টি দেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায় এবং এটি ইংরেজি ভাষায় রূপান্তর করে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তুলে ধরে সে সময়ের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
চলচ্চিত্র জগতের পুরস্কার না পেলেও মাটির ময়না চলচ্চিত্রের ঝুলিতে রয়েছে জাতীয় পুরস্কার। আর সেটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর দুটি পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিকমানের এই ছবিটিতে ফুটে উঠেছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। যেখানে যুদ্ধ ও ধর্মের কারণে বিচ্ছিন্ন একটি পরিবারের আত্মকাহিনী প্রকাশ ঘটে।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের মনে এখনও ব্যাপক জায়গা করে আছে। মূলত এই ছবিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। তবে মূল ভাব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন সময়ে একটি ধার্মিক পরিবারের অবস্থান।
মূল চরিত্র আনুর বাবা কাজী সাহেব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন এবং ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ ছিলেন।
তার মেয়ে যখন দুরারোগ্য রোগে ভুগছিলেন তখন তার মেয়েকে তিনি এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ করে তার মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় আর তার চলে যাওয়া হাজী সাহেবের স্ত্রী আয়েশা সহ্য করতে পারেনি। তাই এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় মতবিরোধ হত।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে অভিনেতাদের অভিনয়। তাদের অভিনয় এতটাই ভাল হয়েছে যে, আমার কথা বলার সাহস নেই। যখন মিলন আয়েশাকে জানায় সে যুদ্ধে যেতে চায় তখন আয়েশার চোখে যে স্বাধীনচেতা ফুটে উঠেছে সেটি সত্যি অভাবনীয়।
আর তার এই চোখের চাওয়াতে ছোট্ট করে একটি ডায়ালগ এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশ স্বাধীন হলে তার কতটা আনন্দ হবে। তাছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষক যখন বলেন যে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা পাকিস্তানকে কে এই অধিকার দিয়েছে? এছাড়াও তৎকালীন সময়ে ভিডিওগ্রাফি তা এই যুগের সাথে অনেকটাই মিলে যায়।
এই চলচ্চিত্রটিতে বেশিরভাগ অংশ আমার কাছে ভাল লাগলেও কিছু অংশ আমার কাছে ভালো লাগে নি যেমনঃ- কাজী সাহেব এবং তার ভাইয়ের মিলনের এর মধ্যে সেই রকম করে কোন কথোপকথন দেখা যায়নি। তাছাড়া তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে দেশ স্বাধীন নিয়ে কোনো কথা হয়নি।
পুরস্কার ও অর্জন
মাটির ময়না চলচ্চিত্রের ২০০২সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এতটাই জনপ্রিয় পেয়েছে যে তার ঝুলিতে প্রচুর পরিমাণে পুরস্কার রয়েছে। আর সেই পুরস্কার গুলো হচ্ছে-
- সেরা চলচ্চিত্র ও ২ টি অন্য পুরস্কার। (কারাফিল্ম উৎসব, পাকিস্তান ২০০৩)
- সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা পরিচালক। (চ্যানেল আই চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৩)
- সেরা চলচ্চিত্র ও ৫ টি অন্যান্য পুরস্কার। (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, ২০০৩)
- ফরাসি সরকারের সাউথ ফান্ড কর্তৃক স্ক্রিপ্ট এওয়ার্ড।
- শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী, শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী (বিশেষ পুরস্কার) ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার (জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ২০০২)
- বিদেশী ভাষার অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশের প্রথম মনোনীত চলচ্চিত্র মাটির ময়না।
- ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস্ এওয়ার্ড। (কান চলচ্চিত্র উৎসব, ২০০২)
মাটির ময়না কেন এত জনপ্রিয়?
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারন হচ্ছে একটি পরিবারের আত্মকাহিনী, যেখানে পরিবারটি দেশের ধার্মিক এবং রাজনৈতিক কারণে কতটা কতটা আত্মঘাতী মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছে।
পরিচালক তারেক মাসুদ মাটির ময়না চলচ্চিত্র এমনভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছে যেন মানুষের হৃদয়ে একটি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে। যেখানে দেশ প্রেম,দেশের প্রতি শ্রদ্ধা্, ভালোবাসা।
অতীতে দেশের মানুষগুলো বর্তমানে মানুষগুলোর জন্য কতটা কষ্ট করেছে সেগুলোর আত্মকাহিনী সিনেমাটিতে উঠে এসেছে। আর তার জন্যই এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই মাটির ময়না সিনেমাটি।
শুধু বাংলাদেশে নয় আন্তর্জাতিকভাবে এই চলচ্চিত্রটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে যারা প্রবাসী তাদের মনে তো অন্যরকম এক অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে। কারণ তারা সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে যে দেশের মাটি কি, পরিবার কি, একটি দেশ তাদের কাছে কতটা মূল্যবান তারা শুধু নিজেরাই জানে।
ছোট ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
মাটির ময়না কার লেখা?
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি রচনা এবং পরিচালনা করেছেন তারেক মাসুদ।
মাটির ময়না ছবির নায়ক কে?
মাটির ময়না ছবির নায়কের নাম নুরুল ইসলাম বাবুল। আর চলচ্চিত্রে তার চরিত্রর নাম ছিল আনু।
মাটির ময়না সিনেমার প্রধান চরিত্র কে?
মাটির ময়না সিনেমার প্রধান চরিত্রের নাম আনু। যার বাস্তব নাম নুরুল ইসলাম বাবুল।
শেষ ভাবনা
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি ২০০২ সালে মুক্তি পেলেও এখন পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি।
পরিচালক তারেক মাসুদ বাংলাদেশের জন্য এমন একটি চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমি যখন এই চলচ্চিত্রটি দেখি তখন আমার মধ্যে এক দেশ প্রেম জেগে ওঠে কারণ এই ছবির মধ্যে এমনভাবে দেশের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এবং একটি পরিবার যুদ্ধের মধ্যে কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি আপনারা এই চলচ্চিত্রটি দেখবেন এবং নিজেদের দেশকে আরো সুন্দরভাবে চিনতে পারবেন এবং সেই সময়কার অবস্থা বুঝতে পারবেন।