যুগ যুগ ধরে মেথি একটি উপকারী তেতো স্বাদযুক্ত হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মেথির অনেক গুণ রয়েছে। এর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। দূষিত এই পরিবেশ এবং ভেজাল খাবারের রাজ্যে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চাইলে মেথি খাওয়ার কোনো জুড়ি নেই।
প্রতিদিন নিয়ম করে মেথি খেতে পারলে আমাদের শরীরের অনেক রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আবার মেথি মানুষের বয়স কমিয়ে রাখতেও সাহায্য করে। ডাক্তাররা ডায়াবেটিস রোগী থেকে শুরু করে হৃদরোগের রোগী পর্যন্ত প্রায় সবাইকেই পরামর্শ দিয়ে থাকে বেশি বেশি মেথি খাওয়ার জন্য।
তবুও মেথির উপকারিতা (methir upokarita) নিয়ে মানুষের বেশ সন্দেহ রয়েছে। লেখার একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে ইনশাআল্লাহ সব পরিস্কার হয়ে যাবে!
চলুন শুরু করা যাক!
মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা
মেথি খাওয়ার উপকারিতার অপরিসীম। এটা রান্নায় যেমন ব্যবহার করা হয়, তেমনি প্রসাধনী তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই ভেষজ উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। পাঁচফোড়নেও এই মেথি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মেথির যেরকম উপকারিতা রয়েছে পাশাপাশি এর কিছু উপকারিতাও রয়েছে। মেথি খাওয়ার উপকারিতা (benefits of fenugreek seeds) ও অপকারিতা জানার আগে জেনে নিই মেথির গুণাগুণ সম্পর্কে।
আপনি জেনে অবাক হবেন যে, এক চা চামচ পরিমান মেথির বীজের পুষ্টিগুন –
- ৩৫ ক্যালরি,
- ৫ শতাংশ ম্যাগনেসিয়াম,
- ৭ শতাংশ ম্যাংগানিজ,
- ৩ গ্রাম প্রোটিন,
- ৩ গ্রাম ফাইবার এবং
- ১ গ্রাম ফ্যাট।
মেথির উপকারিতা (৮টি উল্লেখ করছি)
১. ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে মেথির অনেক ভূমিকা রয়েছে। কারন মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমান ফাইবার এবং এমন এমন উপাদান যা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। মেথি শরীরের সুগার শোষণ করে এবং কার্বহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এছাড়াও মেথি খাওয়ার ফলে হজম শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এসব কারনে ডায়বেটিস রোগীদের জন্য মেথি একটি উপকারী জিনিস।
২. হার্টের রোগ
মেথি এমন একটি ভেষজ যা শরীরের এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। আর এসিডের মাত্রার নিয়ন্ত্রণ থাকা একজন হার্টের রোগীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। তাই হার্টের রোগীদের জন্য ও মেথির উপকারিতা অপরিসীম।
৩. কোলেস্টেরল কমাতে ভূমিকা
আপনার শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমান বেশি থাকলে তা কমাতে সাহায্য করবে এই মেথি। এছাড়াও কলেস্টেরলের ফলে আপনার শরীরে ইতিমধ্যে যে ক্ষতি সাধন হয়েছে তা আস্তে আস্তে সেরে তুলবে। তাই কোলেস্টেরল আছে বা বেশি এরকম রোগীদের নিয়ম মাফিক মেথি খাওয়া উচিত।
৪. হজম শক্তি বৃদ্ধি
মেথিতে যেসকল উপাদান রয়েছে তা হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত। এতে প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকে যা আপনাকে আস্তে আস্তে হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে। তাই হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইলে মেথি নিয়ম অনুযায়ী খাওয়া উচিত।
৫. ক্যান্সার
ক্যান্সারের মত মরণব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে মেথি ব্যবহার করতে পারেন। এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নিয়মিত রান্নায় মেথি ব্যবহার করলে ক্যান্সারের আশংকা অনেকাংশে কমে যায়। মেথিতে রয়েছে ট্রাইগ্লিসেরাইড। এর মাধ্যমে এস্টোজেন গ্রহণকারী মডিউলেটরের মত কাজ করে শরীরে। তাই বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ও কমে যায়।
৬. ওজন কমাতে ভূমিকা
মেথি শরীরের মেদ গলিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে ক্যালরি, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাংগানিজ, প্রোটিন, ফাইবার ইত্যাদি। এগুলো হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। পাশাপাশি এগুলো মেদ কমাতে সাহায্য করে। তাই রান্নায় পরিমানমত মেথি ব্যবহার করুন।
৭. চুলের যত্ন
চুলের যত্নে মেথির তুলনা নেই। চুলের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য চুলের যত্ন নিতে হয়। আর এ জন্য মেথির ভূমিকা অপরিসীম।
৮. গ্যাস্ট্রিকের নিয়ন্ত্রনে
গ্যাস্ট্রিক নিয়ন্ত্রনেও ভেষজটি বেশ কার্যকরী।
গ্যাস্ট্রিকের জন্য মেথি খাওয়ার নিয়ম: পানিতে ভিজিয়ে রেখে রস খেতে হবে। এক্ষেত্রে, প্রতি গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ মেথির রস নিবেন। মেথি সকালে বা রাতে ভিজিয়ে রেখে যথাক্রমে রাতে বা সকালে খেতে পারেন।
মেথির অপকারিতা
মেথির গুনাগুন এর পাশাপাশি এর অল্প কিছু অপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ
১. মেথির তেঁতো দানা বা মেথির রস কারো মুখে গেলে বমি বমি ভাব হতে পারে। এছাড়াও মেথির অতিরিক্ত গন্ধের কারনে অনেকেই অপছন্দ করেন।
২. একটানা বেশ দীর্ঘদিন মেথি খেলে শরীরে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হতে পারে।
৩. গর্ভবতী মহিলাদের মেথি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। গর্ভবতী মহিলারা বেশি মেথি খেলে বাচ্চা জন্মদানের সময়ের আগেই জন্ম হতে পারে বা গর্ভপাতও হতে পারে।
৪. মেথি ব্যবহারে ব্লাড সুগার কমে যায়। তবে বেশি খেলে বা একাধারে অনেকদিন খেলে ব্লাড সুগারের পরিমান বেশি কমে গেলে আরো ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
মেথি খাওয়ার নিয়ম
মেথি খাওয়ার নিয়ম নিম্নে আলোচনা করা হল-
মেথি দুইভাবে খাওয়া যায়। একটা হলো মেথির জল খাওয়ার উপকারিতা, আরেকটি হলো মেথির গুড়ার উপকারিতা (মশলা হিসেবে)।
- প্রথমে আসি মেথির জল খাওয়ার উপকারিতায়। প্রথমে গরম পানিতে মেথির দানা ভিজিয়ে রাখুন। ১০-১৫ মিনিট সময় ভিজিয়ে রাখুন। থিতিয়ে গেলে এবার পানিতে মধু ও লেবু মেশান। এবার তরলটি পান করুন। আপনারা সরাসরি এভাবে মেথি খেতে পারেন।
- মেথির গুড়া খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে। এর নিয়ম হলো খাবারে মশলা হিসেবে খাওয়া। যেমনঃ বিভিন্ন রান্নার মশলায় বা মাছ ভাজাতেও মেথি ব্যবহার করা যায়। এছাড়া সালাদ, রুটি, পরোটা, দোসা, ইডলি ইত্যাদিতেও মেথি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ওজন কমাতে মেথির উপকারিতা
মেথি শরীরের মেদ গলিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে ক্যালরি, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাংগানিজ, প্রোটিন, ফাইবার ইত্যাদি। এগুলো হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। এর পাশাপাশি এগুলো মেদ কমাতে সাহায্য করে। তাই রান্নায় পরিমানমত মেথি ব্যবহার করতে পারেন।
মেথিতে রয়েছে ফাইবার যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় “Galactomannan” বলে। এটি সহজে পানিতে গলে যায়। এই উপাদানটি ওজন কমাতে বেশ ভূমিকা রাখে। একটি গবেষণার মাধ্যমে এটা জানা যায় যে, মেথি খেয়ে চর্বির পরিমান একেবারে কমানো সম্ভব। তবে তাতে ৫০০ মিঃগ্রাঃ মেথি ৮ সপ্তাহ টানা খেতে হবে।ন
পুরুষের জন্য মেথির উপকারিতা
পুরুষদের ক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় মেথি বেশি উপকারী। পুরুষের যৌন সমস্যা দূর করে সুস্থ করে তুলতে মেথির ভূমিকা অসাধারণ। এছাড়াও কমন কিছু রোগ, যেমন ডায়বেটিস, ওজন কমানো, কোলেস্টেরল ইত্যাদির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মেথির গুরুত্ব অপরিসীম।
মেথিতে এক ধরনের যৌগ পদার্থ রয়েছে। এর নাম “সাপোনিস” একে অনেকে “ডাইওসজেনিন” বলেও চেনে। এই উপাদানটি মানুষের হরমোনের গুলো স্তর ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
মেথি পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করে যা যৌন সমস্যা দূর করতে সক্ষম। যৌবন শক্তি বাড়াতে এই মেথির ভূমিকা অসাধারণ। মেথি নিয়মিত খেলে বৃদ্ধ বয়সেও তারুন্যের ছাপ থেকে যায়।
সবশেষে বলা যায়, মেথি পুরুষের যৌবন শক্তি বৃদ্ধির এক মহৌষধ। তাই যাদের এই ধরনের সমস্যা আছে তারা নিয়মিত মেথি খাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে পারেন।
কালোজিরা ও মেথির উপকারিতা
কালোজিরার গুণাগুণ বলে শেষ করা যাবে না। এমন কোনো রোগ নেই যেই রোগ কালোজিরা খাওয়ার মাধ্যমে দূর হবে না। হাজার রোগের মুক্তির এই কালোজিরার ব্যবহার বহু আগে থেকে চলে আসছে। এটি মানুষের শরীরে এমনভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যে রোগ দূর হয়ে যায়।
কালোজিরার গুনাগুণ
চলুন মেথির গুণাগুণ সম্পর্কে জেনে নিই। এর মধ্যে রয়েছে, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৩ ইত্যাদি। এছাড়াও দুইটি এসিড রয়েছে, যেমনঃ লিনোলিক এসিড ও অলিক এসিড।
মেথির উপকারিতা সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। অনেকে চাহিদা অনুযায়ী দুইটিই একইসাথে ব্যবহার করেন। এতে তেমন কোনো ক্ষতি হবার ভয় নেই। উপাদান অনুযায়ী কাজ করবে।
চুলের জন্য মেথির উপকারিতা (এবং কিভাবে ব্যবহার করবেন)
চুলের যত্নে মেথি কতটা কার্যকরী তা কম বেশি সবাই আমরা জানি। চুল পড়া, খুশকি থেকে শুরু করে সব ধরনের সমস্যা দূর করে উজ্জ্বল, কালো, ঝলমলে চুলের জন্য মেথি ব্যবহার করা উত্তম।
যেভাবে কাজ করেঃ
মেথিতে রয়েছে বিভিন্ন উপাদান যেমনঃ ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি ইত্যাদি। এসব উপাদান চুল পড়ার সমস্যা থেকে উদ্ধার করে। আর এর মধ্যের ভিটামিন ই উপাদানটি চুলের সাথে সাথে নখের জন্য ও উপকারী। চুলের বৃদ্ধির জন্য রয়েছে মেথির ভিতরের প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন জেলাটিন। এ উপাদান চুলের সিল্কি ভাব এনে দেয়।
ব্যবহার পদ্ধতি
ফুটন্ত গরম পানিতে ২ চামচ মেথির গুড়া নিন। ভালোভাবে পেস্ট করে মিশিয়ে নিন। চুলের গোড়ায় লাগিয়ে ২০-২৫ মিনিট রেখে দিন। তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত ২ বার এমন করুন।
মেথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
মেথির অনেক উপকার থাকলেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর সেগুলো হচ্ছে-
- মাত্রাতিরিক্ত মেথি খাওয়ার ফলে ডায়রিয়ার সমস্যা হতে পারে।
- হজমে সাহায্য করলেও পরিমাণে বেশি সেবন করলে সেটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে মেডিকেলে ব্লাড সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি কমে যেতে পারে।
- রূপচর্চার কাজে ব্যবহার করলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে শরীরের দুর্গন্ধ হতে পারে।
- গর্ভকালীন সময়ে পরিমাণে বেশি সেবন করলে গর্ভপাত হতে পারে।
সবাই আরও যা জিজ্ঞেস করে
মেথি শাকের উপকারিতা কি?
উত্তরঃ খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণের দিক থেকে অনন্য শাক হচ্ছে মেথি শাক। তারুণ্য ধরে রাখতে মেথি শাক এর গুরুত্ব অপরিসীম। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি যদি মেথি শাক খায় তাহলে এটি তার হতাশা কাটাতে সাহায্য করে।
মেথি শাক যেমন আপনার শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে পাশাপাশি আপনার ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতেও কাজ করবে। এছাড়াও মেথি শাকের আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে। করে আবার পাশাপাশি আমাদের কোলেস্টরেল কে ও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
শেষ ভাবনা
আশা করি আমরা আপনাদেরকে আমাদের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে মেথির উপকারিতা সম্পর্কে অবগত করতে পেরেছি।
মেথি উপকারিতার পাশাপাশি আমরা মেথি সম্পর্কিত আরও তথ্য প্রদান করেছি। আমি যদি কোনো তথ্য ভুল বা মিস করে থাকি কমেন্ট করে জানাতে পারেন। বিদায়!