মদিনা সনদ ও এর ৪৭ টি ধারা

স্বদেশভুমি মক্কা ত্যাগ করে ইয়াসরিবে আশ্রয় নিলে হযরত মুহাম্মাদ(সঃ) কে আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা সাদরে বরণ করে নেন। এসময় তিনি সহল এবং সোহায়েল্ভাইদের কাছ থেকে একটা খেজুরের বাগান কিনে সেখানে আবাসস্থান ও মসজিদ নির্মাণ করেন। ৬২২ খৃষ্টাব্দে মদিনায় নির্মীত এই মসজিদটিই ইসলামের প্রথম মাসজিদ।এখানে নবি মুহহামদের পরিবারের লোকজন ও সাহাবিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। এটাকে নবীর মসজিদ বা মসজিদ আন নওয়াবী বলা হয়ে থাকে।

এখানে এসে হযরত মুহাম্মদ(সঃ)পাঁচ ধরনের অধিবাসীদের সাথে পরিচিত হন। এরা হচ্ছেন-শরণার্থী,সাহায্যকারী,ইহুদী,খৃস্টান ও পৌত্তলিক।

নবী (সঃ) মদিনায় আউস ও খাজরাজদের সহযোগিতায় সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধে উদবুদ্ধকরে ইসলামের নতুন সামাজিক ভিত্তির সূচনা করেন। ঐতিহাসিক হিট্টির মতে,রক্তের সম্পর্কের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে সুশৃংখল সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা আরবের ইতিহাসে এই প্রথম।

মদিনায় আসার প্রাক্কালে আনসারদের সাথে ইহুদীও খৃষ্টানরা একত্রে হযরত মুহম্মদ(সঃ)কে সাদরে বরণ করে নিলেও পরবর্তীকালেতারা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে নবি(সঃ) ও মুসলিমদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। ওই সময় মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল।সে সময় আরবের কন নগরেই আইন-শৃংখলা ছিল না। বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে বিবাদে লিপ্ত থেকে সর্বত্র অরাজকতা এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি করে রেখেছিল।

মদিনা সনদ কি?

হিজরতের পরে হযরত মুহম্মদ(সঃ) এর প্রথম কাজ ছিল কলহো-বিবাদে লিপ্ত মদিনাবাসীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে চিরতরে হিংসা-বিদ্বেষ,যুদ্ধ-বিগ্রহ উচ্ছেদ করা। 

ধর্মীয় অধঃপতন ও হতাশা,সামাজিক অসন্তোষ, কুসঙ্গস্কার, রাজনোইতিক বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা থেকে বাঁচার জনয ইয়াসরিব বা মদিনাবাসী একজন মহাপুরুষ ও ত্রাণকর্তাহিসেবে হযরত মুহম্মদ (সঃ) কে মদিনায় অত্যান্ত সম্মানের সাথে সাদরে আমন্ত্রন জানায়।

মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সহমর্মিতা সৃষ্টির মানসে হযরত মুহম্মদ (সঃ) একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন করার সংকল্প করেন। 

তিনি আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে একতা এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনসহ ইহুদী-খৃস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সহনশীল মনোভাব তৈরি করতে ৪৭ টি শর্তের একটি সনদ প্রণয়ন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাকেই বলা হয় মদিনা সনদ।

মদিনা সনদের প্রেক্ষাপট কি?

  • মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত: মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। হিজরতের পর মদিনায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যেও ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
  • মদিনার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ: মদিনা একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মী শহর ছিল। এখানে মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করত। এদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বিরোধ দেখা দিত।
  • মক্কার কুরাইশদের হুমকি: মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদেরকে হুমকি দেয়। তারা মদিনার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।

এই প্রেক্ষাপটে মহানবী (স.) মদিনার সকল গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন। এই চুক্তির নাম হলো মদিনা সনদ।

মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে মদিনার সকল গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলমানরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়। এসব কারণে মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

মদিনা সনদের ৪৭ টি ধারাসমূহ

মদিনা সনদে সর্বমোট ৪৭ টি শর্ত রয়েছে। এগুলো হল-

(১) মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সকল সম্প্রদায় সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করিবে এবং সবাই একত্রে একটি সাধারণ জাতি বা কমনওয়েলথ গঠন করিবে।

( ২) হযরত মুহম্মদ (সঃ) নব গঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রধান হইব্বেন এবং পদাধিকার বলে তিনি মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারক হইবেন।

(৩) মুসলমান-অমুসলমান সম্প্রদায় পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্ম পালন করিতে পারিবে।কোন অবস্থায় কেহ কাহারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না।

(৪) কুরাইশদের সাথে কেউ কোনো প্রকার সন্ধি স্থাপন করিতে পারিবে না এবং কেউই মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়া কুরাইশদের সাহায্য করিতে পারিবে না।

(৫) সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো গোত্র অথবা সম্প্রদায় বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হইলে সকলে মিলিয়া বহিঃশত্রুর আক্রমন প্রতিহত করিতে হইবে।

(৬) বহিঃশত্রুর আক্রমণে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমুহ স্ব-স্ব যুদ্ধ বযায় বহন করিবে।

(৭) সনদে স্বাক্ষরকারি সম্প্রদায়ের কোনও ব্যক্তি অপরাধ করিলে তাহা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসাবে গন্য করা হইবে এবং ইহার জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দোষী করা চলিবে না।

(৮) মদিনা শহরকে পবিত্র শহর বলিয়া ঘোষনা করা হইল এবং রক্তপাত,হত্যা,বলৎকার এবং অপরাপর অপরাধমুলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হইল।

(৯) অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তিভোগ করিতে হইবে এবং সকল পাপী বা অপরাধিকে ঘৃণার চোখে দেখিতে হইবে।

(১০) ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করিবে ।

(১১) দূর্বল ও অসহায়দের কে সর্বোতভাবে সাহায্য ও রক্ষা করিতে হইবে।

(১২) হযরত মুহম্মদ (সঃ)’র অনুমতি ছাড়া মদিনাবাসিগন কাহারও  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে পারিবে না।

(১৩) স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে হযরত (সঃ) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাহার সমাধান করিবেন।

(১৪) সনদের শর্ত ভঙ্গকারির উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হইবে।

(১৫) পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে। এটা হচ্ছে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে লিপি। কুরাইশ ও  ইয়াসরিবের মুমিন ও মুসলমানদের মধ্যে এবং যারা তাদের অধীনে, তাদের সাথে শামিল হবে বা তাদের সাথে জিহাদে মিলেমিশে কাজ করবে। মদিনা শরীফ পূর্ববর্তী নাম হলো “ইয়াসরীব” ছিল।[৯]

(১৬) আর যখন তোমাদের মধ্যে কোন বিরোধ উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ তা’আলা ও মুহাম্মদ (সা)-এর নিকট তা উত্থাপন করতে হবে।

(১৭) আর ইয়াহুদীরা যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমগণের সঙ্গে মিলেমিশে যুদ্ধ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যুদ্ধের ব্যয়ও নির্বাহ করবে।

(১৮) বানু আউফ, বানু নাজ্জার, বানু হারিস, বানু সাঈদা, বানু জুশাম, বানু আউস ও বানু সালাবার ইয়াহুদীরা; জাফনা উপগোত্র যা সালাবার শাখাগোত্র, বানু শুতাইবার লোকজন, সা’লাবাদের মাওয়ালীরা মু’মিনদের সাথে একই উম্মতরূপে গণ্য হবে। ইহুদীদের জন্যে তাদের ইহুদি ধর্ম, মুসলমানদের জন্যে তাদের ইসলাম ধর্ম, তাদের দাসদের এবং তাদের নিজেদের ব্যাপারে একথা প্রযােজ্য হবে। তবে যে ব্যক্তি জুলুম বা অপরাধ করবে, সে তার নিজকে ও স্ব গোত্রবাসীদেরকে ছাড়া অন্য কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা।

(১৯) এবং ইহুদী শাখাগোত্রসমূহও তাদের মূল গোত্রের লোকদের সমান অধিকার লাভ করবে—বিশ্বস্ততায়, বিশ্বাস ভঙ্গে নয়।

(২০) তাদের মধ্যকার কেউই মুহাম্মদ-এর অনুমতি ব্যতিরেকে যুদ্ধার্থে বহির্গত হবেনা।

(২১) এবং যখমের প্রতিশোধ গ্রহণের পথে কোন বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করা হবেনা। যে ব্যক্তি রক্তপাত করবে, সে নিজে ও নিজ পরিজনদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। অবশ্য, যে অত্যাচারিত হয়েছে এবং (সে হিসাবে) আল্লাহর আনুকূল্য পাবে (তার কথা স্বতন্ত্র)।

(২২) ইহূদীদের উপর তাদের নিজেদের ব্যয়ভার বর্তাবে এবং মুসলিমগণের উপর তাদের নিজেদের ব্যয়ভার বর্তাবে।

(২৩)যে কেউ এই চুক্তিনামা গ্রহণকারী কোন পক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে, তার বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য করবে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও মঙ্গল কামনার সম্পর্ক থাকবে। একপক্ষ অপরপক্ষকে সুপরামর্শ দেবে। বিশ্বস্ততা সুরক্ষা ও শক্তিশালী করবে, বিশ্বাস ভঙ্গ বা বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা।

(২৪) আর কোন পক্ষ তার মিত্র পক্ষের অপকর্মের জন্যে দায়ী হবেনা আর অত্যাচারিতই সাহায্যের হকদার বলে গণ্য হবে।

(২৫) আর ইয়াহুদীরা যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাসীদের সাথী ও সহযোদ্ধারূপে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারাও যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করবেন।

(২৬) আর ইয়াসবির উপত্যকা এই চুক্তিনামার সকল পক্ষের কাছে মহাপবিত্র ভূমি বলে গণ্য হবে।

(২৭) আর কোন পক্ষের আশ্রিত ব্যক্তি আশ্রয়দাতার সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভ করবে—যে কোন ক্ষতিসাধন করবেনা এবং অপরাধ করবেনা।

(২৮) আর কোন নারীকে তার পরিবারের লোকজনের অনুমতি ব্যতিরেকে আশ্রয় দেয়া যাবেনা।

(২৯) এই চুক্তিনামা গ্রহণকারী পক্ষসমূহের মধ্যে যদি এমন কোন নতুন সমস্যার বা বিরোধের উদ্ভব হয়-যা থেকে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে তা আল্লাহ তায়ালা এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ-এর নিকট মীমাংসার্থে উত্থাপিত করতে হবে। এ চুক্তিনামায় যা কিছু রয়েছে এর প্রতি সর্বাধিক নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছেই খুবই পছন্দনীয়।

(৩০) কোন কুরাইশকে বা তাদের সাহায্যকারীকে নিরাশ্রয় দেওয়া চলবে।

(৩১) আর চুক্তির সকল পক্ষ ইয়াসবির আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করবে।

(৩২) যখন তাদেরকে সন্ধির জন্য আহবান জানানো হবে, তখন তারা সন্ধিবদ্ধ হবে। অনুরূপ যখন তারা সন্ধির জন্যে আহবান জানাবে তখন মুমিনদেরকেও সন্ধির আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। তবে, যদি কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তবে তার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য হবেনা।

(৩৩) প্রত্যেককে তার নিজের দিকের প্রতিরোধের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।

(৩৪) আর আউসের ইহুদিরা—তারা নিজের গোত্রবাসীই হোক বা তাদের মাওয়ালীই হোক, এইচুক্তিতে শরীক পক্ষসমূহের সমান অধিকার লাভ করবে এই চুক্তির পক্ষসমূহের সাথেই সুসম্পর্কের ভিত্তিতে।

(৩৫) আর এ চুক্তিনামা কোন অত্যাচারী বা অপরাধীর সহায়ক বিবেচিত হবেনা। যে ব্যক্তি যুদ্ধে বের হবে এবং যে ব্যক্তি মদীনায় বসা থাকবে, উভয়েই নিরাপত্তার হকদার বিবেচিত হবে; অত্যাচারী এবং অপরাধী এর ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে।

(৩৬) আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মদ ঐ ব্যক্তির পক্ষে রয়েছে,যে চুক্তিপালনে নিষ্ঠাবান ও আল্লাহকে ভয় করে।

(৩৭) ইহুদীরা ও মুসলিমরা তাদের স্বযুদ্ধের ব্যয়ভার নিজের গোত্রবাসীরাই বহন করবে।আর যারা এই চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাদের বিপক্ষে সাহায্য করা চুক্তিবদ্ধ সবার জন্য আবশ্যক হবে। চুক্তিবদ্ধ দলসমূহ মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক শুভকামনা ও সদুপদেশের মতো থাকবে এবং তাদের মাঝে অন্যায় ও অপরাধের পরিবর্তে উদারতা এবং মহানুভবতার সম্পর্ক বিরাজ করবে। নিশ্চয়ই মিত্রের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করবেনা। অবশ্যই নিপীড়িত,অত্যাচারিত, নির্যাতিত,শাসিত-শোষিতকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করা হবে।

(৩৮) মুমিনরা যতদিন যুদ্ধরত অবস্থায় থাকবে ইহুদীরাও তাদের সাথে মিলিতভাবে যুদ্ধব্যয় বহন করবে।

(৩৯) ইয়াসরীব উপত্যকা এই চুক্তিবদ্ধ শরীকদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ।

(৪০) প্রতিবেশীরা স্বগোত্রলোকদের মতই নিরাপত্তা ভোগ করবে, তাদের কোনো ক্ষতি করবেনা আর তারাও কোনো অপরাধ লিপ্ত হবেনা।

(৪১) নগরবাসীর অনুমতি ব্যতীত কোনো মদিনার বাহিরে ব্যক্তি নিরাশ্রয় দেয়া যাবে।

(৪২) ইয়াসরীব বহিশত্রুর আক্রমিত হলে প্রত্যেক চুক্তিবদ্ধ শরীকদলের উপর তাদের সম্মুখে নগরাংশে সুরক্ষা করার দায়িত্ব-কর্তব্য বর্তাবে। ইহুদিদেরকে কোন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন জন্য আহ্বান জানানো হলে তারা সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করবে।একইভাবে মুসলিমদেরকে কোন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপনের জন্য আহ্বান জানানো হলে মুমিনদের সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। তবে ধর্মীয় কারণে যুদ্ধ হলে সেকথা ভিন্ন ও পৃথক।

(৪৩) এটি আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঘোষণাপত্র যা কুরাইশদের অন্তগর্ত মুসলিম ও মুমিনদের এবং ইয়াসরীববাসী ও তাদের অধীনস্থ হয়ে যারা সম্মিলিতভাবে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে তাদের জন্য প্রযোজ্য।

(৪৪) বানু আউস গোত্রের ইহুদিরা এবং তাদের মিত্ররা এই চুক্তিতে অন্তগর্ত অন্যান্য শরীকদলের মত সমান অধিকার ও দায়িত্ব রাখেন। এই ঘোষণাপত্র সম্পাদকদের কাছে থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে ও ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লাভ করবে। অপরাধী ব্যক্তি কেবল নিজের অপরাধের দায়িত্ব বহন করবে। যে ব্যক্তি ন্যায়নিষ্ঠার সাথে চুক্তি পালন করবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সহায়ক হবেন।

(ক) এই চুক্তিতে কোনো অত্যাচারী-অপরাধী বা চুক্তিভঙ্গকের জন্য একটি আক্রমণকবচ।যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তার জন্য রয়েছে সম্পূর্ণরূপে নিরাপত্তা বন্দোবস্ত আর যে ব্যক্তি যুদ্ধ অংশ নিবেনা নিষ্ক্রিয় হয়ে বাড়ীতে বসে থাকবে তার জন্য রয়েছে সম্পূর্ণরূপে নিরাপত্তা বন্দোবস্ত।
(খ) প্রত্যেকেরই যেদিকে থেকে তার অংশ সেদিকে পাবে।

(৪৫) আল-আউসের ইহুদীরা, তাদের মুক্তিদাতারা এবং নিজেরা এই দলিলের লোকদের কাছ থেকে বিশুদ্ধভাবে আনুগত্যের সাথে এই দলিলের লোকদের সাথে একই অবস্থান করে। আনুগত্য বিশ্বাসঘাতকতা বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা. যে অর্জন করে তার নিজের জন্যই অর্জন করা উচিত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দলিল অনুমোদিত ও সম্মতিযোগ্য।

(৪৬) এই কাজটি অন্যায়কারী ও পাপীকে আক্রমণ করবে। যে ব্যক্তি যুদ্ধ করতে বের হয় এবং যে ব্যক্তি শহরে বাড়িতে থাকে সে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকে যদি না সে অন্যায় ও পাপ না করে থাকে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভাল এবং খোদাভীরু মানুষের মহারক্ষক এবং মুহাম্মদ (সঃ) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত একজন(খাতামুন নাবিয়্যিন) নবী ও রাসূল।

মদিনা সনদের ১৪ টি প্রধান ধারা

তবে এসব শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান ১৪ টি শর্তাবলী হচ্ছে-

1.    অন্যদের মোকাবিলায় তারা এক উম্মত বলে গণ্য হবে।

2.    কুরাইশের মুহাজিরগণ, বানু আউফের লোকেরা (আনসারগণ), বানু সাঈদা, বানু হারিস, বানু জুশাম, বানু নাজ্জার, বানু আমর ইবনে আউফ, বানু নাবিত,বানু খাযরাজ ও বানু আউস তাদের পূর্ব প্রথানুযায়ী রক্তপণ আদায় করবে এবং তাদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ পরিশোধ করে তাদের মুক্ত করবে। যাতে করে মুমিনদের মধ্যকার পারস্পারিক আচরণ ন্যায়ানুগ এবং ভারসাম্যপূর্ণ হয়।

3.    আর মুমিনদেরকে নিঃস্ব অভাবগ্রস্তরূপে ছেড়ে দেয়া হবে না। যাতে করে তারা ন্যায়ানুগভাবে মুক্তিপণ ও রক্তপণ পরিশোধ করতে পারে।

4.    কোন মুমিন ব্যক্তি অন্য মুমিন ভাইয়ের অনুমতি না নিয়ে অন্য কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে না।

5.    আল্লাহভীরু মুমিনরা ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে থাকবে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অন্যায় করবে বা গুরুতর অবিচার, পাপ, সীমালংঘন বা মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তৎপর হবে, তাদের সকলের সমবেত হস্ত তার বিরুদ্ধে উত্থিত হবে- যদিও সে তাদের কারো আপন উত্তরাধিকারীও হয়।

6.    কোন মুমিন ব্যক্তি কোন কাফিরের জন্যে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করবেনা বা কোন মুমিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবেনা।

7.    নিঃসন্দেহে আল্লাহর জিম্মা বা অভয় অভিন্ন। তাদের যে কোন সাধারণ ব্যক্তি কাউকে অভয় দিয়ে সকলকে সে চুক্তির মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে আবদ্ধ করতে পারবে। আর মুমিনগণ অন্যান্য লোকের মোকাবিলায় পরস্পর ভাই ভাই।

8.    আর ইয়াহূদীদের মধ্যে যারা আমাদের আনুগত্য করবে, তারাও সাহায্য ও সমতার হকদার বলে গণ্য হবে, তাদের প্রতি জুলুমও হবেনা আর তাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করাও চলবেনা।

9.    আর মুসলমানদের সন্ধিও অভিন্ন সন্ধি। আল্লাহর রাহে যুদ্ধে কোন মুমিন ব্যক্তি অপর কোন মুমিন ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শত্রুর সাথে সন্ধি করবেনা—যাবৎ না এ সন্ধি সকলের জন্যে সমান ও ন্যায়ানুগ হবে।

10.  এবং আমাদের পক্ষের শক্তিরূপে যারা আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে, তাদের একে অপরের পিছনে থাকবে।

11.  আর ঈমানদারগণ আল্লাহর রাহে মৃত তাদের একের রক্তের বদলা অপরে নেবে।

12.  আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুমিন মুত্তাকীগণ সব চাইতে সহজ-সরল ও সঠিক পথে রয়েছে।

13.  আর কোন মুশরিক বা পৌত্তলিক ব্যক্তি কোন কুরাইশের সম্পদ বা প্রাণের আশ্রয়দাতা হবেনা এবং কোন মুমিন ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে বাধা দিতে পারবেনা।

14.  আর যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে আর সাক্ষ্য-প্রমাণে তা প্রমাণিতও হয়ে যাবে, তার উপর থেকে কিসাস গ্রহণ করা।

মদিনা সনদের ইতিহাস

হযরত মুহম্মদ (সঃ) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় গমনের (হিজরত) পর শান্তিস্থাপনের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেন । বিশ্বের ইতিহাসে মদিনা সনদই প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধানকেই মদিনা সনদ বলা হয়।

মদিনা সনদ প্রণয়নের দ্বারা কীভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়?

মদিনা সনদ প্রণয়নের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দিকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

  • মদিনা সনদ একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি ছিল। এটি মদিনার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে।
  • মদিনা সনদ মুসলমানদেরকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
  • মদিনা সনদ ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।

মদিনা সনদের মূল বিষয়বস্তু হলো:

  • মদিনার সকল অধিবাসী, মুসলমান ও অমুসলমান, একটি উম্মত বা জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে।
  • মদিনার সকল অধিবাসীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান বজায় রাখা হবে।
  • মদিনার সকল অধিবাসীকে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করতে হবে।

মদিনা সনদের মাধ্যমে মদিনার সকল গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলমানরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়। এসব কারণে মদিনা সনদ প্রণয়নের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের নিম্নলিখিত নীতিমালাগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়:

  • সমতা: মদিনার সকল অধিবাসী, মুসলমান ও অমুসলমান, আইনের চোখে সমান।
  • সাম্য: মদিনার সকল অধিবাসীর মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান বজায় রাখা হবে।
  • ন্যায়বিচার: মদিনার সকল অধিবাসীর অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
  • সমর্থন: মদিনার সকল অধিবাসীকে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করতে হবে।

এই নীতিমালাগুলি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মদিনা সনদের গুরুত্ব কি?

মদিনা সনদ একটি ঐতিহাসিক চুক্তি যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় প্রণয়ন করেন। এটি পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়। মদিনা সনদের গুরুত্ব নিম্নরূপ:

  • ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক: মদিনা সনদ ধর্মীয় সহিষ্ণুতার একটি অনন্য দলিল। এ সনদে সকল ধর্মের মানুষের সম-মর্যাদার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মের লোকেরা নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা লাভ করে।
  • সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি: মদিনা সনদ মদিনায় সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি রচনা করে। এ সনদ স্বাক্ষরকারী সকল গোত্রের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধন প্রতিষ্ঠা করে।
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: মদিনা সনদ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সনদে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • সাংবিধানিক নীতির প্রবর্তন: মদিনা সনদ সাংবিধানিক নীতির প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সনদে গণতন্ত্র, সাম্য, স্বাধীনতা, আইনের শাসন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইত্যাদি সাংবিধানিক নীতির উল্লেখ রয়েছে।

মদিনা সনদ শুধুমাত্র ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এ সনদ বিশ্বের সকল ধর্ম ও জাতির মানুষের জন্য একটি অনুপ্রেরণা।

মহানবি (স.) কেন হিজরত করেছিলেন?

মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন মূলত তিনটি কারণে:

  • মক্কার কুরাইশদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য: নবুয়ত লাভের পর মহানবী (স.) মক্কার কাফেরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হন। প্রথমে তাদের দ্বারা তিনি গোপনে দাওয়াত চালিয়ে যান। কিন্তু যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন, তখন তাদের নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। তাদের দ্বারা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হন। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়। এই নির্যাতন থেকে বাঁচতেই তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন।
  • ইসলামের দাওয়াতকে আরও সুষ্ঠুভাবে প্রচার করার জন্য: মক্কায় ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য মহানবী (স.)-এর অনেক বাধা ছিল। কুরাইশরা তাঁর দাওয়াতকে বাধাগ্রস্ত করত। কিন্তু মদিনায় তিনি আরও স্বাধীনভাবে ইসলামের দাওয়াত দিতে পারতেন। কারণ মদিনার অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী ছিল। তাই মদিনায় হিজরত করে তিনি ইসলামের দাওয়াতকে আরও সুষ্ঠুভাবে প্রচার করতে পারতেন।
  • ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য: মক্কায় ইসলামের দাওয়াতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহানবী (স.)-এর অনেক সময় লাগত। তাই তিনি মদিনায় হিজরত করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। মদিনায় তিনি মুসলমানদের একত্রিত করেন এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ইসলামের দাওয়াতকে আরও শক্তিশালীভাবে প্রচার করতে পারতেন।

হিজরত মহানবী (স.)-এর জীবনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই ঘটনার মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত আরও শক্তিশালী হয় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

Leave a Comment