রাফিয়া অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগে। তেল-মসলার কিছু খেলেই শুরু হয় পেটের গন্ডগোল। গ্যাস্ট্রিক, পেটব্যথা, এছাড়াও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া আরো কত কি।
একদিন সে মোবাইলে একটা গল্প পড়ছিল। হঠাৎ, এক জায়গার তার চোখ আটকে গেলো।
রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ।
অনেক কৌতূহল নিয়ে সে পড়তে লাগলো। রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা গুলো পড়তে গিয়ে সে দেখলো তার প্রায় সব সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেই লেখা আছে অনুচ্ছেদটিতে।
অনুচ্ছেদটি পড়া শেষে সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, “ সত্যিই কি রোজার এত উপকারিতা রয়েছে!”
আপনিও কি জানতে চান রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাগুলো কি? তাহলে আপনার অবশ্যই এই লেখাটি মনোযোগ সহকারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়া উচিত।
প্রথমেই শুরু করা যাক রোজার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে
আমরা হয়তো সবাই জানি রোজা কি ? তবে, যেহেতু আমরা রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা নিয়ে কথা বলবো তাই রোজার সংজ্ঞাটা না বললে জমে না।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে না খেয়ে থাকাকে রোজা বলে। এই নির্দিষ্ট সময় হতে পারে ২-৩ ঘণ্টা আবার হতে পারে ১২-১৪ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময়।
আমরা বিভিন্ন কারণে রোজা রেখে থাকি। ধর্মীয় অনুশাসন মানতে বা কোনো সার্জারি, আবার রক্ত বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গের পরীক্ষা করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখি।
তো রোজা সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলে? রোজা রাখা সত্যিই কি উপকারী?
জ্বি! রোজা রাখার অনেক উপকারিতা রয়েছে। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, আমাদের দৈনন্দিন প্রায় সব ধরনের শারীরিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে রোজা রাখা।
রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাগুলো একনজরে
- রোজা শরীরকে বিশ্রাম দেয়
- রোজা চর্বি ও কোলেস্টেরল কমায়
- রোজা উচ্চ রক্তচাপ কমায়
- রোজা ক্যান্সার এর মত মরণ ব্যাধি থেকে রক্ষা করে
- রোজা রাখলে চেহারায় সজীবতা আনে, অল্প বয়সেই চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে না
- রোজা টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখে
- রোজা মানসিক স্বাস্থ্যে ঠিক রাখে
- রোজা শরীরের বর্ধনশীল কোষকে বিনষ্ট করে, কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ধরে রাখে
রোজার শারীরিক উপকারিতা
রোজা শরীরকে বিশ্রাম দেয়
আমরা সাধারণত সারাদিনই কিছু না কিছু খেতেই থাকি। দিনে ৩ বেলা ভরপেট নাস্তা করার পর আবার বিকালে নাস্তা না হলে কি চলে!
কিন্তু, আমাদের শরীরেরও তো বিশ্রাম প্রয়োজন। যখন আমরা এই খাবার খাই তখন তা আমাদের পেটে গিয়ে পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র সহ আরো অন্যান্য অঙ্গকে বিপাক কাজে ব্যাস্ত করে ফেলে।
যখন আমরা রোজা রাখি, তখন কোনো খাবার গ্রহণ না করার ফলে আমাদের শরীরে কোনো বিপাক প্রক্রিয়া হয় না বলে আমাদের শরীর একটু বিশ্রাম নিতে পারে। এতে আমরা খুব সহজে ক্লান্ত হই না।
উচ্চরক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল কমায় :
রোজা রাখলে আমদের শরীরবৃত্তীয় কাজ গুলো করতে কম শক্তি প্রয়োজন হয় তাই রক্ত সঞ্চালনও ধীরগতিতে হয়। যা উচ্চরক্তচাপ কমায়।
এছাড়াও এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক করার ঝুঁকি কমে। কোলেস্টেরল এর মাত্রাও অনেকাংশে কমে যায়। একটি গবেষণায় দেখা রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরোল এর মাত্রা প্রায় ৮৮% পর্যন্ত কমতে পারে।
রোজা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে
আমরা যে খাবার খাই তা ভেঙে গ্রুকোজ তৈরি হয় এবং এই গ্লুকোজ থেকে আমরা শক্তি পাই।
ইনসুলিন নামক একধরনবের হরমোন এই গ্লুকোজকে আমাদের কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
আমাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন গ্লুকোজ কে কোষে প্রবেশ করতে দেয়না। ফলে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ জমা হতে থাকে।
অন্যদিকে, রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কম পরিমাণে গ্লুকোজ উৎপন্ন হয় এতে আমাদের রক্তে কম পরিমাণ গ্লুকোজ জমা হয় এবং শরীর ভালো থাকে।
২০১৪ সালের একটি গবেষণায়, অংশগ্রহণকারীদের রোজা রাখতে বলা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় তাদের শরীরে ইনসুলিন অনেকাংশে হ্রাস পায়। গবেষকরা বলেছিলেন যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস চিকিৎসার অংশ হিসাবে রোজা অত্যন্ত কার্যকর।
রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
অটোফেজি
আমাদের শরীরে অসংখ্য মৃত কোষ রয়েছে। এই কোষগুলো-ই ক্যান্সার, টিউমারের মতো ভয়াবহ রোগ তৈরি করে।
তাই, অবশ্যই আমাদের শরীর থেকে এই মৃত কোষ গুলোকে পরিষ্কার করা উচিত, তাইনা?
কিন্তু সেটা আবার কিভাবে করে?
: রোজা রাখার মাধ্যমে।
অটোফেজি কি? আমরা যখন রোজা রাখি তখন আমাদের শরীরের কোষগুলো দীর্ঘক্ষণ খাবার না পাওয়ায় শরীরের মৃত কোষগুলো খেয়ে ফেলে। এই প্রক্রিয়াকে বলে অটোফেজি।
এই প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরের মৃত কোষ ধ্বংস হয়ে যায় এতে ক্যান্সার, টিউমারের মতো ভয়াবহ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আলসারের সমস্যা কমে যায়, ত্বক সতেজ হয়। দ্রুত বয়সের ছাপ এড়াতেও এটি অনেক কার্যকরী উপায়।
কিটোসিস
আমরা যখন খাবার খাই তখন খাবার প্রক্রিয়াজাত হয়ে শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু আমরা যদি পরিশ্রম কম করি তাহলে উৎপন্ন সব শক্তি ক্ষয় হয় না। ফলে তা আমাদের শরীরে মেদ বা চর্বি আকারে জমা হয় যা স্থুলতা, টিউমার এবং ক্যান্সারের মত রোগ সৃষ্টি করে।
কিন্তু, রোজা রাখলে আমাদের শরীর তার কাজকর্ম গুলো সচল রাখতে ওই জমে থাকা চর্বি ভেঙে শক্তি উৎপন্ন করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে কিটোসিস।
এর ফলে আমরা আমদের শরীরের অতিরিক্ত চর্বি থেকে মুক্তি পাই। শরীরের মেটাবোলিজম কমে যায়। রক্তে শর্করার ভারসাম্য ও রক্ষা করে এটি।
রোজা শরীরের কোষগুলিকে শক্তিশালী করে
আমরা অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীর নিজে নিজেই গ্লুকোজ উৎপন্ন শুরু করে একে গ্লুকোজেনেসিস বলে।
এটি আমাদের শরীর হালকা চাপের মধ্যে রাখে যাতে আমাদের কোষগুলির মোকাবেলা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে খাপ খাইয়ে নেয়। অন্য কথায়, তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
মানসিক স্বাস্থ্য
এফকেকে এমকে ইউজিএম মেন্টাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট এডুকেশন স্টাডি প্রোগ্রামের মনোচিকিৎসক এবং চেয়ারম্যান প্রকাশ করেছেন যে রোজা মানসিক চাপ দূর করার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
কারণ মানুষ যখন রোজা রাখে, তখন তার খাওয়া দাওয়া একটি নিয়মের মধ্যে চলে আসে।
নিয়ন্ত্রিত খাদ্যের ব্যবহার চিন্তাভাবনাকে এবং হরমোনের নিঃসরনকে আরও সুসংগঠিত করে।
রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কর্টিসল হরমোনের ভারসাম্যও বজায় থাকে। এই হরমোনের কারণেই আমরা মানসিক চাপ অনুভব করি। সহজ কথায় বলতে গেলে, রোজা আমাদের মানসিক চাপের মাত্রা কমাতে পারে।
রোজার উপকারিতা সম্পর্কে তো জানলাম কিন্তু এর কি কোন অপকারিতা নেই?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোজা রাখলে তা আমাদের উপকার না করে উল্টো ক্ষতি করে দেয়।
নিম্ন রক্তচাপে ভুগলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কম হলে, ইটিং ডিসঅর্ডার থেকে থাকলে রোজা রাখা একদমই উচিত নয়। এতে এই সমস্যাগুলো আরো বেড়ে যেতে পারে।
আবার ডায়েবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখা উচিত।
শেষ ভাবনা
রোজা হচ্ছে সুস্থ জীবন যাপনের একটি আদর্শ উপায়। রোজার ফজিলত শুধু ইসলামেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত।
তবে সবসময় সব পরিস্থিতিতে রোজা রাখলেই আমরা উপকার পাবো না। আমাদেরকে আমাদের শারীরিক অবস্থা, ধর্মীয় বিধি-বিধান ও বয়স বুঝে রোজা রাখতে হবে।
এতে করে আমরা একটি সুস্থ জীবন পাবো।
বলতে না বলতেই একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। প্রিয় পাঠক অনুগ্রহ করে আর্টিকেলটি কেমন লাগল এবং কি কি ভুল বলেছি কিংবা রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিত ষম্পর্কে আপনি কি জানেন কমেন্ট করে জানান।
সবাই আরও যা জিজ্ঞেস করে
রোজা রাখলে কি ওজন কমে?
রোজা রাখলে সাময়িকভাবে ওজন কমতে পারে। তবে, রোজা রাখলেই যে ওজন কমে যাবে, এমন ভাবনা সঠিক নয়। স্বাভাবিক খাদ্যাভাস ছেড়ে হঠাৎ নতুন অভ্যাসের সাথে মানাতে শরীরের খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লাগে যা স্বাস্থ্যের উপর সাময়িক প্রভাব ফেলে।
Reference:
- https://www.bouldermedicalcenter.com/6703-2/
- https://www.medicinenet.com/what_are_the_health_benefits_of_fasting/article.htm